কুয়েতে আল শাহ আল গারবীয়া ক্লিনিং কোম্পানীর প্রায় ১৯০ বাংলাদেশি শ্রমিক নানা ভাবে হয়রানির শিকার হয়ে সহযোগিতার আশায় দূতাবাসের সামনে খোলা আকাশের নিচে সকাল থেকে বিকেল অবধি অবস্থান করেছে। কোম্পানীর কাজে যোগদান না করে তারা এই অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছে বলে জানিয়েছেন কুয়েত প্রতিনিধি কামরুল হাসান বাবলু।
সূত্র মতে, এই সময় শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন- ২০১৬ সালের রমজান মাসে কুয়েতের ম্যান পাওয়ার ব্যবসায়ী ও কুয়েতে আদম ব্যবসার অন্যতম গডফাদার নরসিংদী জেলার বদু ফিরোজ ওরফে বদু’র মাধ্যমে তারা কুয়েতে যায়। বাংলাদেশের গুডলাক ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সী এবং জামান ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস লিঃ এর সহযোগিতায় কুয়েতে আসেন তারা। সেখানে শ্রমিকদের ১০০ কুয়েতী দিনার বেতনে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস বয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আসার পর টালবাহানা শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, তাদের মাসিক বেতন ঠিকভাবে পরিশোধ করেনা কর্তৃপক্ষ। সঠিকভাবে কোম্পানীর শ্রমিকদের আকামাও লাগায় না কর্তৃপক্ষ। কোন শ্রমিক তাদের আকামা লাগানোর কথা বললে মালিক পক্ষ নানা হয়রানি করা শুরু করে। এমনকি দেশে পাঠিয়ে দেওয়ারও ভয় দেখায়। একই সাথে কর্তৃপক্ষ ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে প্রতি শ্রমিকদের কাছ থেকে ৩০০ কুয়েতি দিনার বাংলায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা সমপরিমান আদায় করে নিয়েছে। আর যারা এই টাকা পরিশোধ করতে পেরেছে একমাত্র তাদেরই ভিসা নবায়ন করেছে তারা।
শ্রমিকরা আরো অভিযোগ করেছেন, কোম্পানীর নিজস্ব কোন কন্ট্রাক্ট নেই। তারা কুয়েতের মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানিসহ অন্যান্য কোম্পনীতে চড়া মূল্যে শ্রমিকদের বিক্রি করে দেয়। ঐসব কোম্পানীতে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা মজুরীর কাজ না করিয়ে স্বল্প বেতনে ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করায়। এমনকি মাসিক ৬০ কুয়েতি দিনার থেকে নানা অজুহাতে ২০/২৫ কুয়েতি দিনার কেটে নেয়।
এদিকে, শ্রমিকদের বাসস্থানের অবস্থা আরও করুণ। একই রুমে ডাবল বেডে ১০/১২জন শ্রমিককে গাদাগাদি করে রাখা হয় এমন অভিযোগ করেছেন শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে অবস্থানরত এই ১৯০ জন শ্রমিক সম্প্রতি কোম্পানির মালিক পক্ষের কাছে বেতন দাবি করেন। তথন কোম্পানির মালিক আবু আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল নানা ভাবে হুমকি দেয় শ্রমিকদের। এদিকে, শ্রমিকরা অত্যাচার নিপিড়নের মুখে একজোট হয়ে গতকাল সোমবার ২৭/০২/২০১৭ইং থেকে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। এতে মালিক বাংলাদেশী আদম ব্যবসায়ী গড ফাদার আদম ফিরোজের সহযোগিতায় স্থানীয় পুলিশ এনে শ্রমিকদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং কাজে যোগদানের জন্য নানাভাবে ভয় দেখায়। এক পর্যায়ে ৪/৫ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ।
এই অবস্থায় অন্যান্য শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গতকাল মঙ্গলবার ২৮/০২/২০১৭ তারিখ কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে এসে অবস্থান নেয়।
এই সময় শ্রমিকরা লিখিতভাবে দূতাবাসের শ্রম সচিব কাউন্সিলর আব্দুল লতিফ খানের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। এবং বাংলাদেশী আদম ব্যবসায়ী বদু ফিরোজ ও তার ভাই মনিরুজ্জামান মনুসহ কোম্পানির বিচার দাবি করেন।
এদিকে, শ্রমিকরা তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, তারা একবেলা ভাত খেতে পারে না এক প্যাকেট রুটি নিয়ে ভাগভাগি করে খান। শ্রমিকদের থাকার জায়গা দেখতে গেলে তারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা খাবারের জন্য থাকা রুটি দেখায়।
অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শ্রমিকদের সহমর্মিতা দেখাতে কেউ আসেননি। তবে সাধারণ ২জন বাংলাদেশি কিছু পানির বোতল এবং কিছু স্যান্ডুইস দিয়ে যান খাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর আব্দুল লতিফ বলেছেন, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কোম্পানির সাথে সমাধানের জন্য। শ্রমিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশি আদম ব্যবসায়ী বদু ফিরোজ এর বিষয়টিকেও গুরুত্বসহকারে দেখবো আমরা। আমরা চাই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাক। তাদের ভিসা নবায়ন হয় যেন।
এছাড়া, শ্রমিকদের ব্যারাকের মধ্যে তালা দিয়েও রাখে মালিক পক্ষ। তবে শুধু এই কোম্পানি নয়। আরো বহু কোম্পানি এখানে রয়েছে যারা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করছেন না। কেউ প্রতিবাদ করছে কেউ করতে পারছেনা নানা ভয় ভীতির কারনে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এদিকে, যে কয়জন আদম ব্যবসায়ী রয়েছেন তাদের মধ্যে বদু ফিরোজ, কুমিল্লা গ্রুফের নেতৃত্বে আব্দুল বারেক, জাহাঙ্গীর, বরিশালের সুলতান হোসেন আবুল, আল তোয়েক কোম্পানীর তারেকুর রহমানসহ আরো অনেক আদম ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। এসব গড ফাদারদের রয়েছে বড় নেটওয়ার্ক। তাদের এইসব নেটওয়ার্ক বিভিন্ন কোম্পানীর মালিকদের কাছে প্রতিযোগিতা করে ভিসা সংগ্রহের জন্য বিরাট অংকের অর্থ প্রদান করে। মূলত এদের প্রতিযোগিতার কারনে ২লক্ষ ভিসার মূল্য ৮ লক্ষ টাকায় পৌঁছেছে। ২ বৎসর মেয়াদি কাজের মাত্র ৬০ দিনার বেতনে এতো বিশাল অংকের খরচের টাকা আদৌ তোলা সম্ভব নয় এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ।
ঐসব দালালদের অপতৎপরতায় সাধারন প্রবাসীরাও রয়েছেন আতঙ্কে। নানা ভাবে সাধারন প্রবাসীদের ভিসা সংগ্রহের জন্য ঐসব গডফাদাররা তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্ররোচনা দিতে থাকে। সময়মত নানা মন্ত্রী এম. পি দেরও নাম ভাঙ্গায় ঐসব দালালরা। এইভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি করতে থাকে সাধারন প্রবাসীদের।
বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে এরা অত্যন্ত পরিচিত মুখ। এদেরকে ও নেটওয়ার্কের সংঘবদ্ধ দলকে আইনের সহযোগিতায় থামাতে না পারলে পরিস্থিতি যেকোন সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে কুয়েতের শ্রম বাজারে এমনটাই মনে করছেন সাধারণ প্রবাসীরা।